জাপানের কবি ইনুও তাগুচি
কবি ইনুও তাগুচি’র জন্ম ১৯৬৭ সালে। তাঁর প্রথম কবিতার বই
‘টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি অরফান’ (১৯৯৫)। দ্বিতীয় বই
‘জেনারেল মু’ (২০০০)। এই বইটির জন্য তিনি জাপানের তাকামি জিউন পুরষ্কার লাভ করেন। তাঁর অন্যান্য কবিতার বইগুলি— ‘আর্মাডিলজিক’ (২০০২), ‘সেন্ট ফ্রান্সিসকো’স বার্ড’ (২০০৮)।
কখনো উইট আর হিউমারের বর্মে, কখনো সারল্য আর অকপট আন্তরিকতায় কলম ভিজিয়ে তাগুচি লেখেন। নিজেকে নিয়ে তাঁর কবিতায় সচরাচর তিনি কথা বলেন না। অন্তত সরাসরি তো বলেন না। অন্যান্য চরিত্রদের মুখে নাটকীয় একান্ত কথনের মাধ্যমে তিনি কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যান।
অদৃশ্য ওয়েটার
মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব মাংসের টুকরোতে একটা কামড় বসিয়ে বললেন,
‘‘এমন কি আমরা যখন ভীষণ ক্ষুধার্ত,
তখনো স্রেফ মনের শান্তিটুকু দিয়েই মাংস খাওয়া যায় না।
যদিও, উল্টোদিকে এটাও ঠিক, সময়ের প্রতি পূর্ণতাবোধই মনের শান্তি আনে।’’
‘‘আমরা সবাই জানি, আমাদের উল্টোপাল্টা খাবারদাবার
না-খাওয়াই ভালো। প্রার্থনার জন্য আমাদের শরীর
ও মনকে একত্র করাই প্রয়োজন।
অ্যামেরিকানদের মতো গাদা গাদা ভিটামিন ট্যাবলেট খাওয়াতে কিন্তু
বুদ্ধের কঠোর নিষেধ আছে।’’
মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব কথা বলছিলেন পাকা হাতে ছুরি আর
কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে খেতে; কথা বলছিলেন
বৌদ্ধভূমির খাঁটি উচ্চারণে।
‘‘আমার খুব কঠিন সময় গেছে ইউরোপিয়ান খাবার
টেবিলের কায়দা শেখার সেই দিনগুলিতে।
যাই হোক, আমাদের তো সবকিছুতেই সেরা হতে হবে।
তিন-রাতের একটা বৈঠকে
ইউরোপিয়ানরা যেভাবে একশ’ বছরের অগ্রগতি ঘটিয়ে ফেলে।’’
‘‘হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমরা অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ।
ঠিক যেমন তুমি। আর ততদিন আমাদের সমস্যাগুলোও
থাকবে।’’
আরেকদিন আমি যে বোধিসত্ত্বের সাথে দেখা করেছিলাম
তিনি অনিদ্রায় ভুগছেন; তাই রাত্রিবেলা তাঁকে
আলো জ্বালিয়ে পড়তে দেখি— ‘তিন রাজ্যের প্রেমের কাহিনি’
তিনি আমাকে বলেন, পুরো একমাস ঘুমোননি, এবং
এর মধ্যে ৩০০০ পাতা পড়ে ফেলেছেন।
‘‘এক মূর্তিমান নির্বাণকে আমি জানি, খুব
ভালোভাবেই জানি, যাকে সরকারের লোকজন
বিছানায় পড়ে থাকা বুড়ো মানুষ মনে ক’রে
বুড়োদের আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সেই প্রথম আমি তাঁকে কাঁদতে দেখেছিলাম,
‘না! না!’’’
রাত অনেক হয়ে গেছিল,
সব ওয়েটাররা বাড়ি ফিরে গেছে।
বেড়ালের হাসির মতো
শুধু মানুষের হাহাকার
শুধু নৈঃশব্দ পড়ে আছে মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের সামনে
আমি একটা অস্তিত্বহীন সিগারেট নিলাম মুখে, আর
ঠিক তক্ষুনি, এক আলোকভেদ্য স্বচ্ছ ওয়েটার
এসে হাজির হলো
আর খুব নম্রভাবে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল
আমার মুখে।
আর্মাডিলজিক
আর্মাডিলো : একটি স্তন্যপায়ী জীব। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গল ও বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে এদের বাস।
দৈর্ঘ্য ৪০ সে.মি.। এদের পেছনদিক আঁশের মতো কঠিন খোলসে ঢাকা। এরা নিশাচর, গাছের পোকা ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
জাপানি ভাষায় একে ‘বুলেটপ্রুফ ইঁদুর’ও বলা হয়।
১.
আর্মাডিলোর দেশে কোনো ডিকশনারি নেই।
কেননা তাদের নিয়ম হল, সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পরেই
কোনো জিনিসের সংজ্ঞা দেওয়া যায়।
আর, আর্মাডিলোর দেশে কোনো কিছুই আজও বিলুপ্ত নয়।
২.
যখন একটা আর্মাডিলো একটা বলের মতো গড়িয়ে যায়
লোকেরা জানে না যে, পুব-পশ্চিমের অর্ধগোলক
এখানেই তৈরি হয়েছিল;
এখানেই বিষুবরেখা আর আন্তর্জাতিক তারিখরেখা আছে,
তারা এ-ও জানে না।
উত্তর-দক্ষিণ সীমান্ত নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই।
মানুষেরা সেখানে নিজেদের সমস্যাতেই, নাজেহাল।
৩.
মানুষের ফেলা অ্যাটম বোমা নিয়ে আর্মাডিলোদের কিচ্ছু জানা নেই।
তাই তাদের ঘর হিরোশিমায় ছিল না বলে
ভগবানকে তারা ধন্যবাদও জানায় না।
ঈশ্বর তাদের দিকে একদৃষ্টে স্থির তাকিয়ে থাকেন। চুপচাপ।
৫.
জন্মগতভাবে প্রকৃতিসচেতন ব’লে আর্মাডিলোরা গর্বিত।
ইসাবেলা দ্বীপে তারা কারখানা বানায় না।
কিয়োটো প্রোটোকলও ভাঙে না।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা কোন মর্যাদা চায়।
আর্মাডিলোরা খুব ভালো করেই জানে, মর্যাদার ব্যাপারটা, মানুষের জন্যেই রাখা।
৬.
যখন হোটেল-রেস্টুরেন্টে মানুষ চিকেন তন্দুরির জন্য লাইন দিচ্ছে,
ধর্মপ্রাণ আর্মাডিলোরা সারাটা দিন চার্চে প্রার্থনা করে কাটায়
তারা সবসময় চায়, একদিন বাইবেলের অনুবাদ হবে,
আর্মাডিলজিক ভাষায়।
এমন কি খারাপ অনুবাদেও তারা কিছু মনে করবে না।
৯.
যখন দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম আকাশে রামধনু দেখা যায়
আর্মাডিলোদের মন তখন নাচতে থাকে।
ধার্মিক, নাস্তিক সবাই,
সবাই একসাথে আকশের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর চোখের জল ফেলে।
যদি কোন মানুষ বলে, সে কখনো আর্মাডিলোকে কাঁদতে দেখেনি
তবে সেটা তার উদাসীনতা। আর আলস্য।
নিরামিষাশীদের জন্য
জন লেনন মারা গেছেন।
পার্কের বেঞ্চে বসে যিশু বললেন :
‘‘নিশ্চই মোটা চালের ভাত আর নিরামিষ খাবারের জন্য।’’
আমি বললাম, ‘‘না, একেবারেই তা নয়, জন লেননকে খুন…’’
আমাকে মাঝপথেই থামতে হল,
কেননা যিশু এরমধ্যেই একটা নিউ ইয়র্ক টাইমস খুলে ফেলেছেন
আর সেখানে এই বিষয় নিয়েই একটা লেখা আছে।
কাল রাতে ঘরে ফিরে দেখি জনের একটা মেল এসেছে।
আতিমা শহরে চারদিনের খাদ্য-মেলায় সে আমাকে
সঙ্গী করতে চায়। কোন কিছুতে প্রচণ্ড উৎসাহী হলে মানুষ কি
এটাও ভুলে যায় যে, সে আর বেঁচে নেই,
মারা গেছে?
কি বলব একে? সত্যি খুব, খুব বাজে ঘটনা।
যিশু স্যাণ্ডউইচটা নিয়ে বললেন : ‘‘আমি যখন প্যালেস্তাইনে
ছিলাম, আমার চেহারা বেশ ভালোই ছিল। ম্যানহাটানে আসার পর
থেকেই সব ভুলভাল হচ্ছে। এটা কি খুব বেশি
ভাজাভুজি খাওয়ার জন্য?’’
‘‘জানো, যতবার জনের সাথে তর্ক করতাম,
হেরে যেতাম। তখন আমার শিষ্যরাও খুব
হতাশ হ’ত আর কি। বুদ্ধ একবার আমাকে একটা
খাঁটি কথা বলেছিল, বাজে খাবার হচ্ছে আমাদের কর্মফল।’’
তো, জন ভাবতো দুনিয়ার সব মোটা চালের ভাত
খেয়ে নেবার জন্য সে একাই কাফি।
স্বর্গের ওরিয়েন্টাল মার্কেটে মনে মনে আমি জনকে দেখি
ওর দু’চাকার গাড়িতে চালের বস্তা তুলছে।
আর বেরিয়ে এসে বিড়বিড় করে বলছে :
‘‘আরে, চেহারার দিকে আমি কোনদিন থোড়াই কেয়ার করেছি হে !
মোদ্দা কথাটা হল, মরা মানুষরাই সবথেকে তাজা। আর টাটকা।’’
সেন্ট্রাল পার্কের ওপরে আকাশটা, যেদিকেই দেখা যায়, নীল।
আমার ধীরে ধীরে মনে হল, এরকম
আকাশের নিচে যদি জনের একটা ফোন কি মেসেজ আসে
মোটেই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আর ঘরে ফিরে আরো নিশ্চিত হলাম এ ব্যাপারে।
জনের একটা মেল এসেছে :
‘‘খাওয়ার বিপরীত না-খাওয়া নয়।
খাওয়ার বিপরীত হল প্রার্থনা।
কারণ আমরা যখন প্রার্থনা করি, যেভাবেই করি,
আমরা খেতে পারি না।’’
মহান লোকেদের জীবন
লেনিন
লেনিনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
তাই নামিয়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর ব্রোঞ্জ মূর্তি।
আসলে, প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে
তিনি চেয়েছিলেন রেড স্কোয়্যারে শুয়ে থাকতে
আর কোন রোববারের বিকেলে
পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে সমুদ্রের ধারের ছেলেদের
হৈ-হৈ শুনতে। কিন্তু এটা তিনি
কাউকে বলে যান নি।
তাই তাকে ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু করে রেখে দেওয়া হয়।
নিজেকে একবার ওরকম একটা স্ট্যাচু ভাবুন তো!
স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাস দেখছেন।
যা ঐ লোকটাকে নিজের শরীরে বইতে হয়েছিল।
নিউটন
একটা আপেল গাছের নিচে
হঠাৎ নিউটন দেখলেন মহাকর্ষ সূত্রকে,
আর দেখেই, তার প্রেমে পড়ে গেলেন।
ওঃ! সত্যিই সে ছিল নিউটনের চিরন্তন প্রেমিকা—
সেই রাতে নিউটন তাঁর সব ক্ষমতা
উজাড় করে একটা প্রেমপত্র লিখলেন,
নাম দিলেন :
‘মহাকর্ষ সূত্র ও তার প্রেমের জোয়ার’।
মহাকর্ষ সূত্র অবশ্য, এরপরেও,
নিউটনকে পাত্তাই দিল না,
সে ছিল তখন নাচের হিড়িকে মেতে
আর, সে-যুগে ওটা খুব পপুলার ছিল।
সুপারম্যান
হুইলচেয়ারে বসে সুপারম্যান
বাগানে ঘুরছেন। অলসভাবে।
নির্মম জীবন।
যদিও এ মুহূর্তে সূর্যের আলো এসে পড়ছে,
আর এটাই সুন্দর।
যখন আমি আকাশে উড়ে বেড়াতাম
বয়েস তখন নেহাতই কম
আমি উড়তাম ঠিকই,
কিন্তু জানতাম না, এই আকাশে ওড়ার মানে।
তবে এখন ব্যাপারটা অন্য।
এখন আকাশে ওড়া হল,
তোমার ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলোকে নড়ানো
এমনকি সামান্য আধা-ইঞ্চি হলেও।
জীবন একটা তুখোড় তামাশা।
তবে মজার।
তোমার একটা হুইলচেয়ার দরকার
আর তাহলেই তুমি সুপারম্যান হতে পারো।