আলি আবদোলরেজ়ায়েই-এর কবিতায় নিরন্তর পরীক্ষা এবং ধ্রুপদী পার্সিয়ান সাহিত্যের পরম্পরাগত মূল ধারার প্রতি বিরুদ্ধচারিতা দেখা যায়। তাঁর কবিতা ট্র্যাডিশনাল পার্সিয়ান কবিতার ভাষাকেই চ্যালেঞ্জ করে। ১৯৮৯-৯০ থেকে ইরানে খুব স্পষ্টভাবে ‘নিউ পোয়েট্রি মুভমেন্ট’ জেগে উঠতে থাকে। আবদোলরেজ়ায়েই ছিলেন এই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রগতিমূলক চিন্তাগুলোকে নিয়ে পরীক্ষাধর্মী ইরানি সাহিত্য এই সময় থেকেই একটি আকার পেতে শুরু করে। প্রধানত ‘Individualism’-এর ওপরে আলোকপাত ক’রে বেড়ে ওঠে এই ‘New Poetry Movement’। কবিতার মূল লক্ষ্য প্রচণ্ড আবেগ-উচ্ছ্বাসকে প্রকাশ করা ও প্রকৃতির ছবি আঁকা—
এই গৎ বাঁধা ধারণা বর্জন করে তাঁরা বাস্তবের চলতি ভাষায় বিভিন্ন মুহূর্তকে (moment) নিয়ে লিখতে শুরু করলেন।
কবি আলি আবদোলরেজ়ায়েই-এর কবিতার ভাষা, আঙ্গিক, বিষয় একেবারেই স্বতন্ত্র। তিনি সাহিত্যের আঙ্গিক ও বিষয়ের পরিবর্তনকে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সহায়ক হিসেবে দেখেন। কবিতা লেখার শুরুর দিকে আবদোলরেজ়ায়েই নতুন অভিজ্ঞতাগুলোর সাথে
communicate করার জন্য ভাষাকে এক নতুন আঙ্গিকের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করেন। প্রথাগত বাঁধা ধরা ছন্দে তিনি কবিতা লেখেন না। তাঁর কবিতায় শব্দের (word) ধ্বনি-নির্ভরতার (sound-patterns) ওপরে কাজ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর লেখা
obscure এবং dense। অসাধারণ চিত্রকল্প, ভাষার স্বাতন্ত্র্য, বাচনভঙ্গি ও শব্দ চয়নে আচমকা শিফটিং, সমসাময়িক জীবন থেকে তুলে আনা ছবি,
নিজের ভাবনা ও অনুভূতির সাবলীল প্রকাশ, ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ— এগুলোকে তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। কবিতায় প্রথাগত নিয়মকে অস্বীকার করেও এবং
arbitrariness-এর ঝুঁকি রেখেও তিনি পাঠকের সাথে কথা বলেন নির্জনতার গভীর থেকে। কবিতায় ‘multiplicity of words’ meanings’ নিয়ে তাঁকে খেলতে দেখা যায়। কবি আলি আবদোলরেজ়ায়েই মনে করেন,
কবিতা হল, ‘vital part of
the process of social transformation’।
পাগলাঘর
আমি সেই মেয়েটাকে চিঠি লিখছি যে
চাঁদের থেকেও একা
সেই মেয়েটা যে একদিন আয়নায় আলোকিত
যে অল্প হেসে একটা পাথরের চাঁই টেনে নেয় আমার বুক থেকে
সিঁড়ির পায়ের ওপর তুমি কি জুতো রেখে হাঁটো?
হ্রেষায় কেন তুমি জিন টানো না?
ওটা নিশ্চই তোমার চোখ
যা থেকে গ্যালপিং চিঁহির শব্দ হয়
আমাদের শেষ খুশি ছিল হাওয়া যা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে
ইদানিং খবরের কাগজে নদীর ফটোতেও গোরুরা চাটে না
মেঘের স্কার্টে খোঁচা মারছে ভগবানের পা
বয়সের মহিলা থেকে এই বিছানাগুলো এসেছে
আক্রমণ! দাঁড় টানো!
সাঁতার কাটার জন্য যথেষ্ট নৌকো নেই সমুদ্রের কাছে
আবার আমরা মানুষ হলাম
ঠিক এই লাইনে এসে আমি শুনলাম যে তুমি শুনছো, কবিতার একদম শেষে এসে আমি লিখছি
প্রথমে একটু সন্ধ্যে নামলো, তারপরে বৃষ্টি, আর শেষে আমার জুতোর ভেতরে
দৌড়চ্ছে জিন খোলা একদঙ্গল ঘোড়ার চিঁহি
আমার জুতোর চওড়ায় পায়ের হৈ হৈ আজ মারা গেছে
তোমার দিকে
জানি না আমি কোন্ পশম টেনে নেব জানি না
জানি না?
আমার চোখে দুবছর বেঁচে ছিল এমন মহিলার মতো
আমাকে বিছানা থেকে আরেক বিছানায় টেনে নিয়ে যাওয়াটা কি পাপ হবে না?
জীবন হে, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপতে থাকা সৈন্যকে
আমি কিভাবে হুকুম করি : জ্বলে ওঠো?
সিঁড়ির পায়ে রাখা জুতো থেকে শব্দ
ঘোড়াদের লাফিয়ে চলার চিঁহি
আমাকে বিশ্বাস করোনা?
তুমি! দাঁড়িয়ে আছো এ চিঠি শেষের বাইরে
কাঁদার জন্য
শুধু দুটো চোখ আমাকে পাঠাবে
বৃষ্টি
থুত্থুড়ে এক শহরের আকাশে
ছাতাটা খুলতেই
পৌঁছে গেলাম গ্রামের সেইসব দিনে
একটি মেয়ের কাছে যে বৃষ্টির নিচে বেঁকে
ধানের চারা বুনছে
যে হঠাৎ একটা মহিলা হয়ে যায়
বৃষ্টিতে এক মহিলা এখনও দাঁড়িয়ে লম্বা
যে বললো ক’টা বাজে আর শুধোলো সেই লোকটাকে
যার নাম সে জানে না
‘‘দৌড়চ্ছো কেন?
ছাতা কেন সঙ্গে?
যে মানুষ লোহার বৃষ্টিতে তারই শুধু মরচে পড়ে।’’
মেঘ
রাত্রি এসে হাজির হতেই
খাঁচাসুদ্ধ সময় পালালো সে এক দৃশ্য
সকালের বালিশে গলা রেখে
দিন একটু থমকে দাঁড়ালো
আগামীকাল জানে না
তাকে আসতেই হবে
আর রাত দিলো আলোয় একটা কামড়
পড়লো গিয়ে আপেলের এক টুকরোর ওপর যা এসেছে বিশ্বের তৃতীয়তে
পাহাড়ে ঠাণ্ডা
ঝপ্
আর
সবুজ
হামাগুড়ি দিয়ে গিরিখাতে
মানুষ থমকে চৌরাস্তার মোড়ে, পথিক হচ্ছে
সেই একই রাস্তা পরে আরো অনেককে রাস্তা দেখাবে
দিনের মাথা থেকে একটা একটা ক’রে সূর্য তুলে রাখা
আর জমানো যত্নে
তাই নোয়ার নৌকো ছেড়ে যাবার জন্য
জল যখন বন্যা হবে
তলোয়ারকে করে তোলো উদোম এক প্রয়োজন
আবিষ্কার হোক সালফার আর গানপাউডার
জীবনে যোগ হোক তারা
অভিন্ন রাখতে সব
দিন তো এখনো আসে
রাত একটা কালো গোরুর মতো ভেঙে পড়ছে খাবারের গামলাটার জন্য
খয়েরি বাছুরটার পেছনে হারিয়েই গেল দিন
আর নিম্বাস মেঘটা হল একটা হারানো ছেলের মা
আকাশে যে গোল গোল ঘুরেই যায়
আর তাকিয়ে দেখতে থাকে
না, কোনো সামান্য চিহ্নের খোঁজ না
বুক ভেঙে কাঁদার জন্য
ডিক্টেশন
পৃথিবীর সব দেওয়ালের আমি ভাই হয়ে ছিলাম
আর আমার বৌটি একটি জানলা তার শার্সিতে ভোর লাগিয়ে
যেন পেঁয়াজশ্রু
চোখের জলের সাথে চোখের জল
ফুল স্টপ।
বাচ্চারা ! নিজেদের জীবনের কথা সত্যি-মিথ্যেয় মিশিয়ে লেখার জন্য তোমরা পুরো নম্বর পেয়েছো…
না মোড়ের মাঝখানের সবুজটুকু রাস্তায়
নেমে আসে
না পুলিশের দয়া হয় লোকাল ড্রাইভারের
ওপর
না কোনো ম্যাজিক লন্ঠন ঐ হরিৎ-
পীতাভর মুখে
যে-মুখ একাই ভেঙে দিল সংসারটা, আমার,
রাস্তায় যে হেঁটেছে মুক্ত
কোনো ঘরের খবর কখনো প্রাসঙ্গিক নয় তার কাছে
স্টপ
!
পুত্র হে, চেষ্টা করো, মিথ্যেটা ছাড়াই লিখতে, বুঝলে ! আর খেয়াল রেখো, যেন ভুল না হয় :
কেননা তুমি যেখানে চাইবে সেখানেই কিন্তু রাবার থামবে না।
যে লোকটা কবিতা লেখে
সবসময় মুছে দেয় অন্যের কবিতা
কবিরা ! স্টপ রাইটিং ! হ্যাণ্ডস আপ !
হাত তোলো !
চাটনি
ছবিতে ওর হাত দুটো আমি চেপে ধরেছিলাম
দুহাতে
উঠে গেল যখন,
বললো না, ‘আসি’
হাঁটব তোমার সাথে?
না বলেনি
ওর হাত ধ’রে
একটা ছবি হয়ে হেঁটেছি
ছবিটা চোখের ভেতরে
যতবার দেখতে গেছি হারিয়ে ফেলেছি
বাই দ্য ওয়ে তুমি বিয়ে করো নি?
কিছু বলেনি
করবে না?
না বলেনি !
আমরা করে ফেলেছিলাম !
হাওয়ার মতো চলে যাচ্ছিল দিনগুলো
আর রাত সেকেণ্ডের থেকে বেশি বড়ো নয়
আমরা
দুটো একলা ফটো হয়ে ছিলাম
যে ছবিটাকে দুনিয়া চাইছিলো অ্যালবাম থেকে হটাতে
তাড়াতে ! বিশ্বাস হচ্ছে না?
আজকে রাতে আমরা যখন অন্য আরেকটা ফটোয় ঘুমিয়ে
আসতে দাও অ্যালবামটাকে, ঘুরেই যাক
ঐ শটের ভেতরে জমে যাওয়া দরজা খুলে,
আসতে দাও
ওহ্ ! সরি ! ঘরে যে খালি চাটনিই আছে
!
লাস্ট লাইন
জানলার পেছনে একটা কপাল
ওই উঠছে
নামছে
ওর স্কার্ফের এক কোণে হাওয়া
আর দ্যাখো দ্যাখো কেমন গলায় ওটাকে জড়িয়ে, গোল
এক তোড়া ফুল ঐ হাতে
কী দারুণ, না?
এই জায়গাটা থেকে ও তোমাকে দেখতে পাবে না
উঠে আসছে, শুনতে পাচ্ছো? ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে,
শুনছো?
ওই এক, ওই দুই,
তিন....... ছয়….
সিঁড়িটা আর একটু লম্বা হলে
কবিতার শেষ লাইনটা এভাবে বরবাদ করতে পারতো না
বেদানা
শুকনো গাছ
এত ভালো ক’রে সাজলো কি ভাবে
বৃষ্টির নিচে দাঁড়াবে, তাই?
বেদানা ঝুলছে
নিংড়ে নেবে কেউ,
যে এসব কিছুই জানে না?
যে বৃষ্টির নামার কথা এই কবিতায়
নামে না
জীবন
ছোট্ট একটা ঘুমপাড়ানিয়া গান
একটা পৃষ্ঠার ওপরে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে শেষমেশ
যে পৃষ্ঠা আমি জানি না ’ য় জীবনটা কাটালো
যে কবিতা আর কখনো লিখবো না
কতবার
আর তা’
লিখে যেতে হবে
আমি ঠিক জানি লণ্ডন ব্লাড গ্রুপ
অনেকটা O গ্রুপের কাছাকাছি
অথবা আমার সাথে মিলবে না
কেননা বৃষ্টিতে আমি ধাক্কা মেরেই গেছি ভিজে গেছি
কী হরষ পুলকে জড়িয়ে রেখেছে ভাবনা
আমি চাই কেউ আসুক, এসে থামাক
এই দরবেশকে, যে আমার মাথায় চরকিপাক
যে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে, কিন্তু আমার কবিতায় আসছে না
অভিশপ্ত জানোয়ারটা
সবক’টা চোখে জল এনে দিল
বিরাট এই ধর্মপুলিশ
লণ্ডনের আকাশে টেনে আনলো এত এত মেঘ
তাহলে ওপরে কি ফাঁকি দিচ্ছে কোনো কুঁড়ের হদ্দ
না-কি
বৃষ্টিই পড়ছে, এখনো?
সবাই তো মরে যাব
কোনো শেষ নেই তাই
লজ্জা
সেন্সরশিপ
আমার শব্দের গণহত্যায়
ওরা শেষ লাইনের গর্দান কেটেছে
আর রক্ত কালির মতো কাগজে ছিটকে ছিটকে
পাতায় মৃত্যু চওড়া হয়ে আছে
আর জীবন
পাথরে চুরমার আধখোলা জানলা, জানলার শার্সি
একটা নতুন বন্দুক পৃথিবীটাকে শেষ ক’রে দেবে
আমদানি পণ্যের মতো আমি একটা গলি দিয়ে,
দরজা দিয়ে
এখনো সেই কৃশকায় রোগা দেশান্তরী ঘর
জীবনে আমি
খাতার পাতলা পাতায় লাইনগুলোর ওপরে একটা পেন
একটা মা
ইঁদুরকে ভয় দেখাতে
বেড়ালের থাবা এখনো লাফাচ্ছে
এখনো ইঁদুর দৌড়চ্ছে গর্তের দিকে
বইয়ের অনুশীলনীগুলোর পেছনে দৌড়তাম স্কুলে
আমি হুবহু জ্যাক আমার জিলের প্রেমিক
আমার নতুন হোমওয়ার্কগুলো করছি
তুমি কেটে দিচ্ছ
একটা বাড়ি বানাচ্ছি সেই মেয়েটার মধ্যে
যে হঠাৎ পড়ে যাবে এই কবিতার শেষে
দগদগে ক্ষতের মতো যার খোলা দরজা ভ’রে আছে ঘর
মৃত্যুর কিনারা থেকে…
এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়া ঘরের মতো বাঁচছি
একটা মেয়ে যে আমাকে চায়
ছুঁড়ে দেবে হয়ত ওর টুকরো স্বর
ওর শরীরের ওপরে পাগল করে দেবে আমাকে
আবার দরবেশ হতে আমার চোখ ঘুরতে থাকবে বনবন
সে চোখ
শূন্য গর্ত
দুটো শরীরের প্রেমের মাঝখানে হাত হাজার হাত হয়ে যায়
কি ক’রে আমি এদিকের কেউ হব
আমি তো ইরানের সব অন্য দিকে আরো হয়ে আছি
বাবাহত মাহত ভাইহত
আঘাত পাওয়ার থেকেও বড় জটিল আমার এই অবস্থা
আমার থেকেও হীনবীর্য এই লেখালিখি
আর লণ্ডন
লণ্ডনের চুল আবহাওয়ার হাইলাইটস
বোনের মতো অপেক্ষায় বসে আছে
আমাকে আবার মারতে
জীবনের জন্য মৃত্যু ছড়িয়ে আছে শরীরে
সেই কবির জন্য যার শব্দের লাইন আরো আরো লম্বা
শাখাহীন চড়াইটার জন্য যে চেপে আছে ভয় পাওয়া কিচির মিচির
বসার জন্য কোনো তার নেই সেই কাকটাকে ফেরাতে
আমার জন্য
বুক থেকে রক্ত পড়ছে
যে আমি বাড়ি থেকে চলে গেছি যেভাবে হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়
আমি একটা কেউ ছিলাম
বোকার মতো কাজ ক’রে কবি হয়েছি